অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান
আমাদের আজকের আলোচ্য দশম শ্রেণির পাঠ্য কবি জয় গোস্বামীর লেখা অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান কবিতাটি। কবিতার মূলভাব সহ নানা প্রশ্নোত্তর আলোচিত হয়েছে এই পোস্টে। আশা করি, ছাত্রছাত্রীদের উপকারে লাগবে এই আলোচনা। আমরা এর আগে সাহিত্য সঞ্চয়ন গ্রন্থের সমস্ত পাঠ্যই আলোচনা করেছি। আগ্রহীরা এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারো।
অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান – প্রাসঙ্গিক তথ্য
১. উৎস – পাতার পোশাক
২. মূলকথা – অস্ত্র হল মানবতার চিরশত্রু। কবি প্রথমেই তাই অস্ত্র ফ্যালার আহ্বান জানিয়েছেন। গানের বর্ম পড়ে তিনি বুলেট তাড়ান। এই ভাবেই তিনি মানবতাকে বাঁচাতে চান।
৩. উল্লেখিত পাখি – শকুন, চিল, কোকিল
প্রশ্নোত্তর
১. “অস্ত্র ফ্যালো, অস্ত্র রাখো” কবি কোথায় অস্ত্র রাখতে বলেছেন ? তার একথা বলার কারণ কী ?
অথবা – অস্ত্র ফ্যালো, অস্ত্র রাখো পায়ে’ – কবি কেন অস্ত্র ফেলে দিতে বলেছেন? কবির এই আবেদনের মধ্যে তার কোন্ মানসিকতা ধরা পড়েছে?
উত্তরঃ কবি জয় গোস্বামী তার ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় অস্ত্রনির্ভর, ক্ষমতাদম্ভী মানুষদের কাছে অস্ত্র ত্যাগের আবেদন রেখেছেন। অস্ত্র হিংসা, হানাহানি এবং ধ্বংসের প্রতীক। মানুষের নিকৃষ্টতম প্রবৃত্তিকে উৎসাহিত করে অস্ত্র। জাগিয়ে তোলে ক্ষমতার দম্ভ। বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করে মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে দেয়। শুভ চেতনা, সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি মানবিক গুণগুলিকে ধ্বংস করে মানুষকে পিশাচের পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। হিংস্রতা বৃদ্ধি করে পৃথিবীর সংকটকে ঘনীভূত করে তোলে। এমন একটা নেতিবাচক উপাদানের জন্য অর্থব্যয়কে কবি অনর্থক বলে মনে করেন, তাই অস্ত্র ত্যাগের আবেদন রেখেছেন।
কবির এই আবেদনের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী, মানবকল্যাণকামী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতায় কবি আতঙ্কিত। অস্ত্রনির্ভর স্বার্থান্ধ মানুষের পৈশাচিক তাণ্ডবের পরিণতি কী হতে পারে তা তিনি উপলব্ধি করেছেন। তাই সভ্যতার শুভ চেতনা জাগ্রত করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। কবি দেখেছেন বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বিরাট অঙ্কের অর্থ অথচ দেশের সাধারণ নাগরিকের নিরন্ন, কর্মহীন অবস্থা। সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থানটুকু হচ্ছে না। এ এক ক্ষমাহীন অবিমৃষ্যকারিতা। মানুষের শুভ চেতনা জাগ্রত করে তার সৃজনশীল সত্তাকে কবি উৎসাহিত করতে চান। তাই অস্ত্রের পরিবর্তে গানে তার আস্থা। গান হলো প্রাণের ভাষা। গান শুভ চেতনা ও কল্যাণবোধকে জাগ্রত করে। মানবিক গুণগুলির বিকাশ ঘটায়। অস্ত্র গানের কণ্ঠরোধ করে, জীবনকে নারকীয় করে তোলে। কাজেই অস্ত্র ত্যাগের মধ্যেই আছে মানবের প্রকৃত কল্যাণ, আনন্দমুখর জীবনের সন্ধান।
২. ‘রক্ত মুছি শুধু গানের গায়ে”—রক্তপাত হওয়ার কারণ কী ? কবি এখানে কী বলতে চেয়েছেন ?
উত্তরঃ আলোচ্য প্রশ্নোক্ত অংশটি আধুনিক কবি জয় গোস্বামী রচিত ‘পাতার পোশাক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।
অস্ত্র মানুষের হিংসা, অসুয়া, বিদ্বেষ, যুদ্ধবৃত্তি ও ভীতি প্রদর্শনের সহায়ক। অস্ত্র মানুষের জীবন পর্যন্ত নাশ করে। তাই অস্ত্র কখনোই কোনো সভ্যতার প্রগতির সূচক হতে পারে না। মানবতাকে ধ্বংস করে পাশববৃত্তিকে রক্তপাত হওয়ার কারণ জয়যুক্ত করাই তার একমাত্র কাজ। যখনই কেউ অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে যায়, তখনই ঘটে রক্তপাত, তখনই ঘটে প্রাণহানি। দানববৃত্তির সহায়ক অস্ত্রের শক্তি তো পৈশাচিক হবেই। মানবতার পতন ঘটাতে পারলেই তাই অস্ত্রের জয়। কিন্তু কবির মতে মানুষকে অন্তর থেকে রূপান্তরিত করতে সক্ষম গানই শুধু এই দানবিক শক্তিকে পরাহত করতে পারে।
অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান কবিতায় কবি জয় গোস্বামী গান দিয়ে জীবন রক্ষার আনন্দ বার্তাটুকু পৌঁছে দিতে চান। সেই প্রসঙ্গে আলোচ্য উক্তি।
কবি দেখেছেন চারিদিকে হিংসা চক্রান্ত আর মৃত্যুর হোলি খেলা। একে অন্যকে ধ্বংস করে লুঠ করার চক্রান্ত। কবি সেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার বিরুদ্ধে গানের বর্ম গায়ে পড়ে নিয়েছেন। তিনি গানকে ভালোবেসে গানের গায়ে মানুষের রক্ত মোছেন।
৩. “তোমায় নিয়ে বেড়াবে গান”—এই কথার তাৎপর্য কী ?
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি আধুনিক কবি জয় গোস্বামী রচিত ‘পাতার পোশাক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ গানের কথা এবং সুরের সঙ্গে রসিক মানুষের অন্তরের বিশ্ববন্ধন সম্ভব হয়। গানের মধ্যে যেমন রয়েছে প্রখরতা তেমনি রয়েছে মাটির ছোঁয়া। গান হৃদয়ের এক আশ্চর্য বিস্তৃতি ঘটায়। তুচ্ছ জাগতিক বিষয় থেকে মনকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। গানের মাধ্যমে সম্ভব হয় প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ, মানুষ মানুষের কাছাকাছি পোঁছায়। তাই কবি বলেন গানের মাধ্যমে নদীতে এবং দেশগাঁয়ে পৌঁছে যাবে।
৪. “হাত নাড়িয়ে বুলেট তাড়াই”—বলতে কী বুঝিয়েছেন ?
উত্তরঃ কবি জয় গোস্বামী ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় বুলেট অর্থাৎ অস্ত্র থেকে নির্গত গুলি প্রতিহত করার কথা বলেছেন, এখানে হাত নাড়িয়ে বুলেট তাড়ানো বলতে মনুষ্যত্বের গানের সজীবতার কথা, শত আঘাতকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কবি মানবিকতার মন্ত্রকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে চান। এই কথার মাধ্যমে প্রতিবাদী মানুষের কথা বলা হয়েছে।
৫. ‘আমি এখন হাজার হাতে পায়ে’ — কোন্ কবির কোন্ কবিতা থেকে নেওয়া ? ‘আমি’ কে ? ‘হাজার হাতে পায়ে’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন ?
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি আধুনিক কবি জয় গোস্বামী রচিত ‘পাতার পোশাক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।
কবি একজন সাধারণ ও সামান্য মানুষ। অন্যদিকে অস্ত্রের ক্ষমতা প্রভূত। তাই অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হলে যে বিপুল মানসিক শক্তির লাগে, তার জন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ বিরুদ্ধতার। আর তাই-ই প্রতীকায়িত হয়েছে সহস্র মানুষের প্রতিভূ–স্বরূপ ‘হাজার হাতে পায়ে’ শব্দবন্ধের মাধ্যমে। এই দৃঢ় প্রত্যয় শুধু ব্যক্তি মানুষের নয়, সম্মিলিত মানবতার। এজন্য কবি হাজার হাতে পায়ে শুধু এগিয়েই আসেন না, উঠেও দাঁড়ান এবং হাত নাড়িয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বন্দুকের গুলিকে প্রতিহতও করেন। এ কারণেই তিনি বলেছেন ‘এগিয়ে আসি, উঠে দাঁড়াই/হাত নাড়িয়ে বুলেট তাড়াই। অর্থাৎ অন্তরমনের অবজ্ঞাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাতেও লক্ষ্যে অবিচল থাকেন।
৬. ‘আমার শুধু একটা কোকিল/গান বাঁধবে সহস্র উপায়ে’ – কোন্ প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য ?
উত্তরঃ আধুনিক কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় মানবতার মূল মন্ত্র শুনিয়েছেন। কিন্তু যে কোনো অস্ত্র, মানুষের মধ্যে এই হিংসাবৃত্তির জন্মদাতা। কবি উদ্ধৃতাংশের প্রসঙ্গ তাই অস্ত্রের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে গানকে বেছে নিলেন। গান মানুষের হৃদয়বৃত্তির বিশুদ্ধ প্রকাশ। মানুষের অন্তরের সুরময় মানবতা গানের ভাষায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু কবি জানেন, গান দিয়ে অস্ত্রের বিরুদ্ধতা করা খুব সহজ নয়। কারণ শকুন বা চিলরূপী সুযোগসন্ধানী মানুষের হানাদারি দৃষ্টি চতুর্দিকে প্রহরারত, তাই কোকিলের মতো বসন্তদূতকে তিনি সঙ্গী করে নেন।
৭. ‘গান দাঁড়াল ঋষিবালক/মাথায় গোঁজা ময়ূরপালক’ – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বক্তব্যটির তাৎপর্য বুঝিয়ে লেখো।
উত্তরঃ আধুনিক কবি জয় গোস্বামী রচিত ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় কবির মনে হয়েছে, অন্তরকে গানের ঝরনা ধারায় পরিশুদ্ধ করতে হবে। কবি জানেন, গান মানুষের অন্তরের চিরবালকটিকে প্রকাশ করবে; আর শৈশবের পবিত্রতায় মানুষ হয়ে উঠবে প্রকৃতিকোলের নিষ্পাপ রাখাল বালক, যার মাথায় বালক কৃষ্ণের মতোই ময়ূরপালক গোঁজা আছে। এভাবেই গান ক্লান্ত অবসন্ন মানবপ্রাণের আরাম ঘটাবে। গান মানুষকে নিয়ে যাবে নদীতে, দেশে গাঁয়ে। গানের তরঙ্গে মানুষের মনের ‘অহং’–এ আবদ্ধ মানবসত্তা প্রাণময়তার মুক্ত জোয়ারে ভেসে যাবে। এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি ঘটবে সমস্ত ভেদাভেদহীন মানবিকতার অবয়বহীন সুরের মূর্ছনায়, উদ্বোধন ঘটবে মানবতার।
৮.”গানের বর্ম আজ পরেছি গায়ে” —কোন্ প্রসঙ্গে কেন এই কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ আলোচ্য প্রশ্নোক্ত অংশটি আধুনিক কবি জয় গোস্বামী রচিত ‘পাতার পোষাক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।
প্রসঙ্গঃ কবি জয় গোস্বামী রচিত ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান’ কবিতায় বুলেট সর্বস্ব যুদ্ধবাদ মানুষদের রণং দেহি মনোভাবের বিরুদ্ধে কবির এই বক্তব্য। বলার কারণঃ হাজার হাজার মানুষের প্রতিনিধি হয়ে কবি যুদ্ধের এবং শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি গানের বর্ম গায়ে পড়ে নিয়েছেন। অর্থাৎ সুন্দরকে বরণ করে নিয়েছেন। গান আছে বলে কবি জীবনের আনন্দ পান সেই ইতিবাচক বক্তব্য আলোচ্য অংশটির মধ্যে ধরা পরেছে।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল দেখো
| প্রশ্নোত্তরের বিষয় | LINK |
|---|---|
| জ্ঞানচক্ষু | Click Here |
| অসুখী একজন | Click Here |
| আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি | Click Here |
| আফ্রিকা | Click Here |
| হারিয়ে যাওয়া কালি কলম | Click Here |
| বহুরূপী | Click Here |
| অভিষেক | Click Here |
| সিরাজদৌল্লা | Click Here |
| প্রলয়োল্লাস | Click Here |
| পথের দাবী | Click Here |
| অদল বদল | Click Here |
| সিন্ধুতীরে | Click Here |
| বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান | Click Here |
| অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান | Click Here |
| নদীর বিদ্রোহ | Click Here |

