আমরা কবিতা – বিষয়বস্তু ও প্রশ্নোত্তর
আমাদের আজকের আলোচনা নবম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য সঞ্চয়ন গ্রন্থের আমরা কবিতা। আলোচনায় আমরা কবিতার মূলভাব ও নানা প্রশ্নোত্তর দেখে নেব। আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনাগুলি পেতে পেজের শেষ অংশ দেখো।
আমরা কবিতার মূলভাব
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কেবল বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়, বাংলার সংস্কৃতি, প্রাচীন ঐতিহ্য ও গৌরবকেও তুলে ধরেছেন এই কবিতায়। তিনি এই বাংলাদেশকে তীর্থভূমি বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাংলার প্রাচীন গৌরব, শিল্প, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, বিজ্ঞান তথা গুণীব্যক্তিদের কথাও বলেছেন তিনি। এসেছে পুরাণ ও ইতিহাসের কথাও। কবিতাটির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কবি তথা বাঙালির আশাবাদ।
এককথায় প্রশ্নোত্তর
১. কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘আমরা’ কোন শ্রেণির কবিতা ?
উঃ দেশাত্মবোধক কবিতা
২. কবির ভাষায় আমাদের বাসভূমি এই বঙ্গ হল –
উঃ বরদ
৩. কবির ভাষায় বঙ্গদেশের বাম হাতে ‘কমলার ফুল’ আর ডান হাতে ?
উঃ মধুক-মালা
৪. বঙ্গদেশের ‘মুকুট’ হিসেবে কবি কীসের উল্লেখ করেছেন ?
উঃ কাঞ্চন-শৃঙ্গ
৫. ‘কিরণে ভুবন আলা’ – ‘আলা’ শব্দটির অর্থ কী ?
উঃ আলোকিত
৬. কবির ভাষায় বঙ্গদেশের কোল ভরে আছে –
উঃ কনক-ধান্য
৭. বঙ্গদেশের দেহ ভূষিত হয়ে আছে যা দিয়ে –
উঃ অপরাজিতা ও অতসী
৮. কবির ভাষায় আমরা কীসের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি ?
উঃ বাঘ
৯. আমরা কবিতায় পৌরাণিক প্রসঙ্গ আছে এমন একটি চরণ কী ?
উঃ দশানন জয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে
১০. ‘যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে’ – ‘চতুরঙ্গে’র বলতে কী বোঝায় ?
উঃ অশ্ব, গজ, রথ ও পদাতিক।
১১. ‘সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়’ – এখানে কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের কথা আছে ?
উঃ বিজয়সিংহ
১২. ‘চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লিনাথে’ – ‘চাঁদ-প্রতাপ’ কে ?
উঃ চাঁদ রায় ও প্রতাপাদিত্য
১৩. আমরা কবিতায় কবি কোন প্রাচীন ঋষির উল্লেখ করেছেন ?
উঃ কপিল মুনি
১৪. ‘বাঙালি দীপঙ্কর’ কোথায় জ্ঞানের দীপ জ্বেলেছেন ?
উঃ তিব্বতে
১৫. ‘কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষশাতন করি’ – ‘পক্ষধর’ কে ?
উঃ মিথিলার পণ্ডিত
১৬. আমরা কবিতায় উল্লেখিত ‘ওঙ্কার-ধামে’র নির্মাতা কে ?
উঃ রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ
১৭. বিট্পাল ও ধীমান কে ?
উঃ পাল যুগের ভাস্কর্যশিল্পী
১৮. ‘আমাদের পট অক্ষয়’ কোথায় হয়ে আছে ?
উঃ অজন্তায়
১৯. ‘——- মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি’ – শূন্যস্থান পূরণ কর।
উঃ মন্বন্তরে
২০. কবির ভাষায় আমরা কোথায় আমাদের ‘মানুষের ঠাকুরালি’ দেখেছি ?
উঃ কুটিরে
২১. কবির কথায় কার বাণী জগৎময় ছুটেছে ?
উঃ বিবেকানন্দের
২২. ‘বিষম ধাতুর মিলন’ ঘটানোর সূত্রে কবি কার কথা বলতে চেয়েছেন ?
উঃ বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের
ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর
১. “বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি” — কবির একথা বলার কারণ কী ?
উঃ উদ্ধৃত পঙক্তিটি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘আমরা’ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। বাংলার দক্ষিণে অবস্থিত সুন্দরবন প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এবং এখানকার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে তথা কাঠ, মধু, মাছ ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে যায়। তারা প্রায়শই জঙ্গলে বাঘের আক্রমণের মুখে পড়ে। তাই কবি বলেছেন যে, বাঙালি বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করেও বেঁচে আছে।
২. “জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালি দীপঙ্কর।” — তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উঃ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত ‘আমরা’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত পঙক্তিটি গৃহীত হয়েছে। উদ্ধৃত অংশে বিখ্যাত বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। শীলভদ্রের শিষ্য অতীশ দীপঙ্কর পাল যুগে বিক্রমশীলা মহাবিহারের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। তিনি মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে হিমালয়ের বরফাবৃত অতি দুর্গম পথ অতিক্রম করে তিব্বতে যান। তিব্বতে তিনি ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি শিক্ষাদান ও নানা গ্রন্থরচনাও করেন। তাঁর এই কীর্তি বাঙালি জাতির পক্ষে অত্যন্ত গৌরবের।
৩. “মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে” — ব্যাখ্যা করো।
উঃ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা আমরা কবিতা থেকে গৃহীত এই অংশে ‘মুক্তবেণী’ শব্দটির অর্থ হল বাধাহীন জলপ্রবাহ। গঙ্গা নদী তার উৎস থেকে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়া পর্যন্ত বহু নদী তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। কিন্তু তার নিজস্ব জলধারা অন্য কোনো নদীতে হারিয়ে যায়নি। তাই সে ‘মুক্তবেণী’। গঙ্গা এক পবিত্র নদী। হিন্দুদের বিশ্বাস গঙ্গাজল মানুষকে পাপ থেকে মুক্তি দেয়। তাই কবি বলেছেন, গঙ্গা আমাদের সকল পাপমোচন করে এই বাংলায় আনন্দের সাথে মুক্তি বিতরণ করে চলেছে।
৪. ‘আমরা’ কবিতায় কবি কীভাবে বাঙালির গৌরব গাথা তুলে ধরেছেন তা আলোচনা কর।
উঃ আমাদের পাঠ্য ‘আমরা’ কবিতাটিতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালির গৌরব গাথার বর্ণনা দিয়েছেন। কবিতাটিতে ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম সমস্ত ক্ষেত্রে বাঙালির কীর্তিকথা তুলে ধরা হয়েছে।
জলে-জঙ্গলে পূর্ণ বাংলায় বাঙালি জাতি সাপ ও বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। বাঙালি বীর বিজয়সিংহ লঙ্কা জয় করে তার নামকরণ করেন সিংহল। বারােভূঁইয়ার অন্যতম চাঁদ রায়, প্রতাপাদিত্য দিল্লির মােগল সম্রাটের সঙ্গে লড়াই করে শৌর্যের পরিচয় দিয়েছেন।
বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর হিমালয় পেরিয়ে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও শিক্ষাবিস্তার করেন। নবদ্বীপের রঘুনাথ শিরােমণি মিথিলার পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে বাংলার গৌরব বৃদ্ধি করেন। কবি জয়দেবের লেখা কাব্য গীতগােবিন্দ সংস্কৃত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে।
স্থাপত্য-ভাস্কর্য কিংবা শিল্পকলাতেও বাঙালি জাতি অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। পাল যুগের বিখ্যাত ভাস্কর বিটপাল ও ধীমানের কথা বলেছেন কবি। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব, শ্রীরামকৃষ্ণদেব আধ্যাত্মিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাঙালিকে অপূর্ব মহিমা দান করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মুগ্ধ করেছে বিশ্ববাসীকে।
বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গাছে প্রাণের স্পন্দন আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। ড. প্রফুল্লচন্দ্র রায় রসায়নশাস্ত্রে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় মানুষের মহামিলনের কথা বলেছেন। কবির আশা, বাঙালি একদিন তার প্রতিভা ও কর্মপ্রচেষ্টার গুণে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের শিরােপা লাভ করবে।
৫. আমরা কবিতায় বর্ণিত বঙ্গভূমির সৌন্দর্য্য আলোচনা কর।
উঃ আমরা কবিতায় কবির স্বদেশ এবং স্বজাতি বিষয়ে তীব্র ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। এই বঙ্গভূমি তাঁর কাছে নিছক কোনো ভৌগোলিক ভূখণ্ড মাত্র নয়, এই ভূমি কবির কল্পনায় মাতৃরূপে ধরা দিয়েছে। সেই রূপ সৌন্দর্য্য তিনি খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আলোচ্য কবিতায়।
মুক্তধারা গঙ্গা বাংলার ভূখণ্ডের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে সমুদ্রে মিশেছে। কবির মতে গঙ্গার প্রবাহ আনন্দে উচ্ছ্বল। তার পবিত্র জলস্পর্শে বঙ্গের মানুষকে মুক্তি লাভ করে। এই বাংলার বুকে রয়েছে অসংখ্য তীর্থস্থান। তাই বাংলার মানুষ নিজের জন্মস্থানেই তীর্থদর্শনের পুণ্য অর্জন করতে পারে। বঙ্গমাতার বাম হাতে আছে ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর পদ্মফুল। উত্তরে বরফাবৃত হিমালয় পর্বতমালা যা সূর্যের কিরণে সোনার মুকুটের মতো ঝলমল করে। তা থেকে ঠিকরে পড়া আলোতে বিশ্বচরাচর আলোকিত হয়।
বাংলা মায়ের কোলভরা সোনার ধান্য। মায়ের বুকভরা অসীম স্নেহ কারণ তিনি তাঁর সন্তান অর্থাৎ বঙ্গবাসীদের ফুলে-ফলে সমৃদ্ধিতে লালন করেন। মায়ের দেহ অতসী-অপরাজিতায় সুশোভিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর যেন অজস্র ঢেউ দিয়ে মায়ের পা ধুইয়ে দেয়। কবির মনে হয়েছে সাগর যেন তটভূমিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাধ্যমে বঙ্গমাতাকে তার প্রণাম জানায়। সমুদ্র তরঙ্গের কলতানে ধ্বনিত হয় মায়ের বন্দনাগীতি।
এভাবেই কবি ‘আমরা’ কবিতায় আমাদের ‘বাঞ্ছিত ভূমি’ বাংলার অপূর্ব রূপ বর্ণনা করেছেন।

