You are currently viewing ভাব সম্প্রসারণ

ভাব সম্প্রসারণ

বিভিন্ন পরীক্ষাতেই ভাব সম্প্রসারণ প্রয়োজন হয়। আমাদের নির্মিতি বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, প্রতিবেদন যেমন রয়েছে তেমনি দেওয়া হল ভাব সম্প্রসারণের বেশ কিছু উদাহরণ। এই ভাব সম্প্রসারণ তালিকায় থাকা উদাহরণগুলি বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা বা অন্যান্য পরীক্ষার জন্যও সহায়ক হবে।

ভাব সম্প্রসারণ – সেরা ৫

জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর

প্রতিটি জীবের মধ্যেই অবস্থান করেন স্রষ্টা বা ঈশ্বর। তাই জীবের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। জীবকে অবহেলা করে, তার প্রতি আন্তরিক না হয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায় না। জীবের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে।

লোকচক্ষুর অন্তরালে ধ্যানমগ্ন হলেই কিংবা নির্জনে আরাধনা করলেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায় না। স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নানা গুণে সমৃদ্ধ করে – জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে। সেজন্য সমস্ত জীবের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। কাজেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে মানুষের প্রতি যেমন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি প্রতিটি জীবের প্রতিও রয়েছে সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য। জীবের সেবা না করে কেবল ঈশ্বর সেবায় মগ্ন হলে কিংবা জীবকে অবহেলা করে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা যায় না।

এই মহাজগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি। পরম যত্নে তিনিই সৃষ্টি করেছেন সমস্ত জীবজগৎ তথা মানুষ। তাঁর বিশাল শক্তির ক্ষুদ্রাংশ প্রতিটি জীবের মধ্যে বিরাজ করছে। জীবজগতের সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বরের উপস্থিতি রয়েছে। কাজেই জীবের প্রতি ভালবাসা দেখানোই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। কেননা জীবের সেবা করলেই পরোক্ষে ঈশ্বর তথা স্রষ্টার সেবা করা হয়। জীবকে ভালোবাসলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা হয়।

এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

এই পৃথিবীতে কারো চাহিদার শেষ নাই। প্রচুর ধন-সম্পত্তির অধিকারীও আরো ধন-সম্পত্তি পেতে চায়। যা আছে তাতে সে তৃপ্ত নয়। তার চাই আরও। তেমনি বিপুল প্রভাব, প্রতিপত্তি সম্পন্ন লোকও চায় আরও বেশি প্রভাব, আরো বেশি প্রতাপ। এই অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজনে নিরাশ্রয়, গরীব মানুষের শেষ সম্বল কেড়ে নেওয়া হয়।

সর্বক্ষেত্রে আরও বেশি পাওয়ার সীমাহীন লোভ মানুষকে পেয়ে, কারণ তার আকাঙ্খার শেষ নেই। তারা যত চায়, তত পায় বলেই তাদের পাওয়ার দুর্দমনীয় আকাঙ্খা ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী হয়। তা শেষ পর্যন্ত এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে শুধু নিজের সিদ্ধি ছাড়া সে আর কিছুই দেখে না। এই প্রাপ্তির জন্য যে কোনো রকম অন্যায় কাজ করতেও সে দ্বিধা বোধ করে না। তার কৃতকর্মের ভালো মন্দ বিচার করার অবসর তার হয় না। তার মনুষ্যত্ব লোপ পায়। যেন এক হিংস্র পাশব সত্তা তার ভেতর বাসা বাঁধে। ফলে গরীব মানুষের শেষ সম্বল, শেষ আশ্রয়টুকু পর্যন্ত সে কেড়ে নিতে দ্বিধা বোধ করে না। ছলে বলে কৌশলে সে কেবল নিজের প্রভাব আরও বেশি অর্জন করতে চায়। তার এই দুর্বার আকাঙ্খায় গরীবের অসহায়তা বৃদ্ধি পায়।

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি

ক্ষুধার জ্বালা তীব্র ও প্রচণ্ড। এই জ্বালা মানুষের রূপ-সৌন্দর্য ও প্রেমের বোধকে ধ্বংস করে দেয়। তাই ক্ষুধার নিবৃত্তি অত্যাবশ্যক।

মানুষ স্বভাবত সৌন্দর্যপ্রিয় ও কল্পনাবিলাসী। প্রকৃতিতে তার মনকে আকর্ষণ করার মতো অনেক উপাদান ছড়িয়ে আছে। নদীর কুলুধ্বনি, নীল আকাশ, সাদা মেঘ, সবুজ অরণ্য, নানা বর্ণের ফুল, ফল, মায়াবী জ্যোৎস্না যে কোনো মানুষের হৃদয়কে মুগ্ধ করে। প্রকৃতির রূপ লাবণ্য মেখে মানুষ চলে যায় কল্পনার জগতে। বাঁশির সুর তার মনকে করে উদাস। রিমঝিম বৃষ্টির ধ্বনি তার চেতনাকে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরে। এগুলো আমাদের মনকে তৃপ্ত করে, হৃদয়কে শান্ত করে।

কিন্তু রূপ-সৌন্দর্য্য আর কল্পনার বৈচিত্র্য মনকে তখনই নাড়া দেয় যখন ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটে। উদর পূর্ণ থাকলে আকাশে চাঁদের হাসি আনন্দের বাঁধ ভেঙে দেয়। সুগন্ধী ফুলে মাতোয়ারা হয় হৃদয়। রামধনু রঙের খেলা রাঙিয়ে তোলে অন্তর। আর সেই উদরে যদি থাকে খিদের জ্বালা তাহলে সেই রূপ, সেই সৌন্দর্য্যই মনে হয় নীরস গদ্যময়। তীব্র জঠর জ্বালায় যে কোনো গোলাকার জিনিসকে মনে হয় ঝলসানো রুটি। ক্ষুধাই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে আর সবকিছুই তুচ্ছ, গুরুত্বহীন। চাঁদের মায়াবী সৌন্দর্যে ক্ষুধার্ত বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট হয় না। তার জীবন থেকে যেন সব ভালোলাগা, সব রূপ, ছন্দ হারিয়ে যায়। জীবন হয়ে ওঠে বিবর্ণ, ধূলিধূসর।

বন্যেরা বনে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

এই সৃষ্টিক্ষেত্রে সমস্ত কিছুই আপন পরিবেশে স্বাভাবিক সৌন্দর্য্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরিবেশের সঙ্গে থাকে তার স্বাভাবিক ও নিবিড় সম্পর্ক। সেই পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সে তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারায়।

মাতৃক্রোড় শিশুর কাছে নিরাপদ আশ্রয়ই শুধু নয়, অবস্থানগত সৌন্দর্য্যের পূর্ণ। শিশুর সৌন্দর্য্য সর্বাধিক মহিমা তার মায়ের কোলে। শিশু যখন মায়ের কোলে থাকে তখন তার উৎফুল্ল মুখচ্ছবি, তার প্রসন্নতা এক অনুপম সৌন্দর্য্য হয়ে দেখা দেয়। মায়ের কোল থেকে শিশুকে বিচ্ছিন্ন করলে সে কেবল সৌন্দর্য্য হারায় না, নিরাপদ আশ্রয় হারানোর আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা অনুভব করে।

আসলে মানব জীবন ও তার পরিবেশ একে অপরের পরিপূরক। অরণ্যচারী মানুষ আরণ্যক জীবনেই পায় তার স্বাভাবিক স্ফূর্তি। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আপন পথে সে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদের জীবন ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে আরণ্যক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। অরণ্য লালিত সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনেই তারা পরিতৃপ্ত। তারা ঐ পরিবেশের সঙ্গে হয় মানানসই। আধুনিক সভ্যতার ঝলমলে নাগরিক পরিবেশে অরণ্যচারী, বনবিহারী মানুষ তার স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য হারায়। আরণ্যক পরিবেশেই তার অস্তিত্ব সুন্দর হয়ে ওঠে। অতএব, স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে জীবনকে বিচ্ছিন্ন করলে প্রতিটি প্রাণিই তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য হারায়। জীবনের সঙ্গে পরিবেশের যোগ যেমন অবিচ্ছিন্ন তেমনি নিজ নিজ পরিবেশে জীব পায় স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও অনুপম বৈশিষ্ট্য।

স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে

সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তায় আবৃত জীবন মানুষের প্রকৃত জীবন নয়। তা মানুষের জীবনে পূর্ণতা দিতে পারে না। যদি আত্মকেন্দ্রিকতার সংকীর্ণ বলয় থেকে বেরিয়ে বৃহৎ মানবসমাজের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রচিত হয় তবেই মানব জীবনের সার্থকতা।

বেঁচে থাকা বলতে কেবল শারীরিকভাবে বাঁচাই নয়, প্রকৃত বাঁচা হল অন্যের হৃদয়ে আসীন হওয়ায়। তা না হলে কেবল নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা হয়, বেঁচে থাকা হয় না। কুয়োর ব্যাঙ টিকে থাকে কিন্তু সে জীবন উপভোগ করতে পারে না। অন্যদিকে প্রজাপতি রঙিন পাখা মেলে জগতের আলো-হাওয়ায় প্রাণবন্ত জীবন উপভোগ করে। বিশ্বের সঙ্গে যোগে তার জীবন সার্থক হয়।

মানুষেরও প্রকৃত পরিচয় সকলের হৃদয়ে বাঁচার মধ্যে। যে মানুষ কেবল নিজ স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে কেবল নিতে চায়, সমাজকে কিছু দিতে চায় না সে ক্ষুদ্র সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন হয়। সে নিজেকে জগৎ-বিচ্ছিন্নও করে তোলে। স্বার্থের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ মানুষ কখনওই অপরের জন্য স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, সহানুভূতির মতো স্বাভাবিক হৃদয়-ধর্মও হারিয়ে ফেলে। সে বিশাল আকাশের নীচে উন্মুক্ত অমৃতময় জীবনের স্বাদ পায় না। এরকম জীবনে নেই কোনো সার্থকতা, নেই কোনো গৌরব।

প্রকৃত জীবনরসিক মানুষ কখনো স্বার্থমগ্ন থেকে সংকীর্ণ জীবনে আবদ্ধ থাকতে পারে না। সমগ্র মানবসমাজকে নিয়েই সে তার জগৎ রচনা করে। সে কেবল নিজের জন্যে বাঁচে না, বাঁচে সবার সঙ্গে, সবার জন্যে। নিঃস্বার্থ মন নিয়ে পরের জন্যে জীবন উৎসর্গ করে সীমাহীন ভালোবাসায় তার বুক ভরে ওঠে। অপরের হৃদয়েও সে স্থান পায়, বেঁচে থাকে চিরকাল।


প্রবন্ধ রচনা
প্রতিবেদন রচনা
ইউটিউব চ্যানেল

Leave a Reply