প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার

আমাদের আজকের প্রবন্ধ বিজ্ঞান ও কুসংস্কার। প্রবন্ধটি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, উচ্চ মাধ্যমিক তথা অন্যান্য পরীক্ষার জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই শিরোনামে প্রবন্ধটি দেওয়া হলেও অনুরূপভাবে কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞানের ভূমিকা শিরোনামেও লেখা যাবে।

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার – ভূমিকা

বর্তমান যুগ বাস্তবিক বিজ্ঞানের যুগ। এই বিজ্ঞানের দৌলতেই আদিম যুগের মানুষ আধুনিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সেই প্রাচীন মানসিকতার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি ঘটেনি। তাই এখনও টিকটিকির ডাকে, হাঁচির শব্দে কিংবা বিড়ালের রাস্তা পার হওয়ায় অগ্রগতি থমকে যায়। সাপে কাটা রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় ওঝার কাছে। এখনো মানুষ মনোবাসনা পূরণ করতে মাদুলি, কবচ ধারণ করে। আধুনিক মানুষ বাঁধা পড়ে পদে পদে জীর্ণ লোকাচারে।

কুসংস্কার কী ?

কুসংস্কার শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল খারাপ সংস্কার। বলা যায়, যেসব সংস্কার যুক্তিহীন, ভিত্তিহীন এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকারক তাই-ই কুসংস্কার। আদি যুগ থেকে মানুষ নানা বিশ্বাস ও ধারণার বশবর্তী হয়ে জীবন নির্বাহ করত। সেই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেওয়া নানা রীতিই আসলে সংস্কার। কিন্তু এই সংস্কারের মধ্যে যা মানবজাতির অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তা কুসংস্কার। প্রাচীন ভারতে অতিথি, অভ্যাগতদের নমস্কার জানানো একটি সংস্কার কিন্তু যাত্রাকালে হাঁচিকে অশুভ মনে করা এটি কুসংস্কার।

কুসংস্কার কেন ?

পৃথিবীতে প্রাণের ক্রম বিবর্তনের পথে আবির্ভাব ঘটে সর্বোচ্চ বুদ্ধিগুণ সম্পন্ন মানুষের। সেই আদিমকাল থেকেই মানুষ প্রকৃতির অপার রহস্যকে বুঝতে চেষ্টা করেছে। সে তার নিজের অভিজ্ঞতাজাত ধ্যানধারণা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে চালিত করত। প্রাচীন এই সমস্ত বিশ্বাস মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞান যত এগিয়েছে ততই অনেক ভিত্তিহীন সংস্কার ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। আর, যে জায়গায় বিজ্ঞানের আলো পৌঁছায়নি সেখানে শিকড় মজবুত করেছে কুসংস্কার।

নানা শ্রেণির কুসংস্কার

কুসংস্কারের নানা শ্রেণি হতে পারে। যথা, ব্যক্তিগত কুসংস্কার, সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় কুসংস্কার প্রভৃতি। ব্যক্তিগত কুসংস্কার অর্থাৎ যেগুলি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অনেকে পরীক্ষার দিন ডিম বা কলা খাওয়ায় নারাজ থাকে। কিংবা যাত্রা শুরুর সময় জলপূর্ণ কলসি দেখা শুভ লক্ষণ বলে মনে করে।

আর সামাজিক কুসংস্কার একটি সমাজে প্রচলিত যা ব্যাধির মতো। এক্ষেত্রে ডাইনি সংক্রান্ত ধারণা বা সূর্যাস্তের পর ঘর পরিস্কার না করা অন্যতম উদাহরণ। আধুনিক জীবনে এসেও এখনও আমাদের দেশে ডাইনি সন্দেহে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়।

ধর্মীয় কুসংস্কার হল সেইসব কুসংস্কার যেগুলির আড়ালে থাকে ধর্মীয় কারণ। সব ধর্মেই কমবেশি ধর্মীয় কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। একদা প্রচলিত সতীদাহ প্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, জিনের অস্তিত্ব প্রভৃতি ধর্মীয় কুসংস্কারের উদাহরণ।

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার

আমাদের চেতনার এক প্রান্তে যদি কুসংস্কার অবস্থান করে তবে অন্য প্রান্তে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানে কেবল যুক্তির প্রাধান্য। কিন্তু কুসংস্কার যুক্তির ধার ধারে না। তাই বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের একত্র সহাবস্থান সম্ভব নয়। বিজ্ঞান চেতনার কারণে কুসংস্কার দূরীভূত হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কিছু মানুষের মনে বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার পরস্পর সহাবস্থান করে। শিক্ষিত একজন মানুষও অনেক সময় রাস্তায় বিড়াল পারাপার হতে দেখলে গাড়ি থামায়। অনেকে অসুস্থ হলে ডাক্তারের পরিবর্তে কোনো সাধু বা মৌলবীর টোটকা ব্যবহার করেন। আসলে তাদের চেতনায় বিজ্ঞানের থেকে এই সকল অন্ধ বিশ্বাসের পাল্লাই ভারী।

কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞান

আলো যেমন অন্ধকার দূর করতে সক্ষম, তেমনি কুসংস্কারকে চিরতরে নির্মূল করতে পারে একমাত্র বিজ্ঞানই। বিজ্ঞানকে কেবল বইয়ের পাতায় বন্দি রাখলে চলবে না। প্রয়োজন মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ ঘটানোর। তবেই কুসংস্কার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সরকারি স্তরে এবিষয়ে আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে জনমানসে বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার প্রসার ঘটে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক মঞ্চগুলি সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন এবং বর্তমান যুগের সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করা যেতে পারে। তাছাড়া, বিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের নানা দিক আলোচনা করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কুসংস্কারমুক্ত করা সম্ভব। এক কথায়, মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ নিয়ে আসতে হবে। আর তা সম্ভব বিজ্ঞান চেতনা বৃদ্ধি পেলে।

উপসংহার

ভারতবর্ষের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে কুসংস্কার একটি চূড়ান্ত সমস্যা। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ থাকায় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কার প্রচলিত। প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু কুসংস্কার মেনে চলার প্রবণতা আছে। তাই কুসংস্কার দূর করতে সবার আগে প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার। তবেই সমস্ত রকম কুসংস্কারকে সমূলে নির্মূল করা যাবে। তাই কুসংস্কারের প্রাচীরে আঘাত হেনে বিজ্ঞানের শিখা জ্বালাতে হবে।


অনুরূপ

কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞানের ভূমিকা

অন্যান্য প্রবন্ধ

বাংলার উৎসব
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!