ধ্বনিতত্ত্ব

সন্ধি ও সন্ধিবিচ্ছেদ

আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় সন্ধি ও সন্ধিবিচ্ছেদ। যারা মাধ্যমিক শিক্ষার্থী তথা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দেবেন তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আজকের আলোচনাটি। সম্পূর্ণ আলোচনা পেতে পড়ে দেখুন।

সন্ধি ও সন্ধিবিচ্ছেদ – প্রাথমিক ধারণা

‘সন্ধি’ শব্দটির সাধারণ অর্থ ‘মিলন’ হলেও ব্যাকরণে নতুন শব্দ গঠন প্রসঙ্গে এই শব্দটির প্রয়োগ হয়। এই নতুন শব্দ গঠিত হয় ধ্বনির মিলনের কারণে। তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে সন্ধি কাকে বলে ? উত্তরে বলা যায়, পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে। এই মিলন হয় পূর্বপদের শেষ ধ্বনি এবং পরপদের প্রথম ধ্বনির সঙ্গে। নীচের উদাহরণটি দেখুন –

রবি (র্‌ + অ + ব্‌ + ) + ইন্দ্র ( + ন্‌ + দ্‌ + র্‌ + অ) = রবীন্দ্র (র্‌ + অ + ব্‌ + + ন্‌ + দ্‌ + র্‌ + অ)।

এই উদাহরণে পূর্বপদ ‘রবি’র শেষ ধ্বনি ‘ই’ এবং পরপদ ‘ইন্দ্র’র প্রথম ধ্বনি ‘ই’ মিলিত হয়ে ‘ঈ’ হয়েছে। এই মিলনের ফলে নতুন শব্দ ‘রবীন্দ্র’ গঠিত হয়েছে। এইভাবেই মিলনের ফলে বিদ্যালয়, পরমেশ্বর, জলাশয়, বহিষ্কার ইত্যাদি নতুন নতুন শব্দ গঠিত হয়।

সন্ধির শ্রেণিবিন্যাস

সন্ধি ও সন্ধিবিচ্ছেদের আলোচনায় আমরা সন্ধির শ্রেণি সম্পর্কে জানব। সন্ধিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – সংস্কৃত সন্ধি ও খাঁটি বাংলা সন্ধি। সংস্কৃত সন্ধি আবার তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত – স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গ সন্ধি। অন্যদিকে খাঁটি বাংলা সন্ধি দুটি ভাগে বিভক্ত – স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধি।

মনে রাখতে হবে, বাংলায় বিসর্গ সন্ধি নেই। এখন একনজরে বিভিন্ন প্রকার সন্ধি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। প্রথমে দেখে নেব সংস্কৃত সন্ধি সম্পর্কে।

সংস্কৃত স্বরসন্ধি

সংস্কৃত নিয়মানুসারে স্বরধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির মিলন হলে তাকে সংস্কৃত স্বরসন্ধি বলে।

যেমন – জীব + অণু = জীবাণু, স্থান + অন্তর = স্থানান্তর, বৃক্ষ + আবলী = বৃক্ষাবলী, দাঁত + আল = দাঁতাল, যথা + অর্থ = যথার্থ, শ্রদ্ধা + অঞ্জলি = শ্রদ্ধাঞ্জলি, বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়, পরীক্ষা + আগার = পরীক্ষাগার, অতি + ইব = অতীব, পরি + ঈক্ষা = পরীক্ষা, রথী + ইন্দ্র = রথীন্দ্র, স্ব + ইচ্ছা = স্বেচ্ছা ইত্যাদি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃত স্বরসন্ধির নির্দিষ্ট নিয়ম না মেনেই যখন পাশাপাশি অবস্থিত দুটি স্বরধ্বনি সন্ধিবদ্ধ হয় তখন তাকে নিপাতনে সিদ্ধ স্বরসন্ধি বলা হয়।

এই প্রকার সন্ধির কয়েকটি উদাহরণ হল – গো + অক্ষ = গবাক্ষ, মার্ত + অণ্ড = মার্তণ্ড, সম + অর্থ = সমর্থ, গো + ইন্দ্র = গবেন্দ্র, স্ব + ঈর = স্বৈর, কুল + অটা = কুলটা, প্র + ঊঢ় = প্রৌঢ় ইত্যাদি।

সংস্কৃত ব্যঞ্জনসন্ধি

সংস্কৃত নিয়মানুসারে স্বরধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির, ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির মিলন হলে তাকে সংস্কৃত ব্যঞ্জনসন্ধি বলে।

এই প্রকার সন্ধির কয়েকটি উদাহরণ হল – দিক্‌ + অন্ত = দিগন্ত, জগৎ + ঈশ = জগদীশ, পরি + ছদ = পরিচ্ছদ, উদ্‌ + জীবন = উজ্জীবন, তদ্‌ + ময় = তন্ময়, ষট্‌ + মাস = ষন্মাস ইত্যাদি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যঞ্জনসন্ধি নির্দিষ্ট নিয়ম না মেনেই যখন পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ধ্বনি সন্ধিবদ্ধ হয় তখন তাকে নিপাতনে সিদ্ধ ব্যঞ্জনসন্ধি বলা হয়।

এই প্রকার সন্ধির কয়েকটি উদাহরণ হল – গো + পদ = গোস্পদ, পুম্‌স্‌ + লিঙ্গ = পুংলিঙ্গ, দিব্‌ + লোক = দ্যুলোক, বৃহৎ + পতি = বৃহস্পতি ইত্যাদি।

বিসর্গ সন্ধি

সংস্কৃত নিয়মানুসারে বিসর্গের সঙ্গে স্বরধ্বনির কিংবা বিসর্গের সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির মিলনকে বিসর্গ সন্ধি বলে।

এই শ্রেণির সন্ধির কয়েকটি উদাহরণ হল – সরঃ + বর = সরোবর, নিঃ + বোধ = নির্বোধ, শিরঃ + ছেদ = শিরশ্ছেদ, অন্তঃ + ধান = অন্তর্ধান, দুঃ + কর্ম = দুষ্কর্ম, চতুঃ + পদ = চতুষ্পদ ইত্যাদি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিসর্গ সন্ধির নির্দিষ্ট নিয়ম না মেনেই যখন সন্ধি হয় তখন তাকে নিপাতনে সিদ্ধ ব্যঞ্জনসন্ধি বলে।

এই প্রকার সন্ধির কয়েকটি উদাহরণ হল – মনঃ + ঈষা = মনীষা, অহঃ + রাত্র = অহোরাত্র, অহঃ + নিশ = অহর্নিশ, গীঃ + পতি = গীস্পতি ইত্যাদি।

খাঁটি বাংলা সন্ধি

সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম ব্যতিরেকে বাংলা শব্দের নিজস্ব রীতিতে যে প্রকার সন্ধি হয় তাকেই খাঁটি বাংলা সন্ধি বলে।

যেমন – কাম + আর = কামার, যত + এক = যতেক, বঙ্গ + আল = বঙ্গাল, কত + দিন = কদ্দিন, চার + টি = চাট্টি, কাঁদ্‌ + না = কান্না ইত্যাদি। খাঁটি বাংলা সন্ধি দুই প্রকারের – খাঁটি বাংলা স্বরসন্ধি ও খাঁটি বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধি।

খাঁটি বাংলা স্বরসন্ধি

বাংলা শব্দের নিজস্ব রীতি মেনে স্বরধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির মিলন হলে তাকে খাঁটি বাংলা স্বরসন্ধি বলে।

যেমন – দোহা + আর = দোহার, মাইয়া + আলি = মাইয়ালি (মেয়েলি), কত + এক = কতেক, আর + এক = আরেক, অর্ধ + এক = অর্ধেক ইত্যাদি।

খাঁটি বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধি

বাংলা শব্দের নিজস্ব রীতি মেনে স্বরধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির, ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির মিলন হলে তাকে খাঁটি বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধি বলে।

এই প্রকার সন্ধির কয়েকটি উদাহরণ হল – কত + দিন = কদ্দিন, ডাক + ঘর = ডাগ্‌ঘর, দর + জ্বাল = দজ্জাল

মার + না = মান্না, পাঁচ + সের = পাঁশ্‌শের ইত্যাদি।

ধ্বনি পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন। আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রা‌ইব করে নিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!