সাহিত্য সঞ্চয়ন (X)

প্রলয়োল্লাস – কাজী নজরুল ইসলাম

দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমাদের পরবর্তী উপস্থাপনা কাজী নজরুল ইসলামের লেখা প্রলয়োল্লাস কবিতাটি। আমরা এর আগে অন্যান্য পাঠ্য সম্পর্কে আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পরিবেশন করেছি। আজও প্রলয়োল্লাস কবিতা থেকে প্রাসঙ্গিক নানা তথ্য সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর দেখে নেব। আমরা এর আগের পোস্টে সিরাজদ্দৌলা সম্পর্কে বলেছিলাম। আজকের কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। কবিতাটি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পুরোটা পড়।

প্রলয়োল্লাস – প্রাসঙ্গিক তথ্য

কবিতাটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২) থেকে গৃহীত।
কবিতাটি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩২৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

শব্দার্থ

দ্বাদশ-রবি – মধ্যাহ্নের সূর্য, মাভৈঃ – ভয় নেই, দিগম্বর – মহাদেব, পিঙ্গল – হলুদাভ ঈষৎ লাল রঙ,

প্রশ্নোত্তর পর্ব

১. “আসছে নবীন জীবন হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন?” – উক্তিটির তাৎপর্য লেখ।

উত্তরঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় প্রলয়ের দেবতা রুদ্রদেবকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কবির কল্পনায়, দেশের নবীন প্রজন্মই হল নবযুগের বার্তাবাহী সেই রুদ্রদেব। দেশমাতৃকার মুক্তি সাধনার ব্রতে ব্রতী তরুণ বিপ্লবীরা প্রথমেই জরাজীর্ণ পুরাতন মানসিকতার উপর আঘাত হানবে। যা কিছু জীবনী শক্তিহীন তথা অসুন্দর, সেইসব কিছুর বিনাশ করবে তারা। এইভাবে একটি মৃতপ্রায় সমাজব্যবস্থার ধ্বংসের মধ্য দিয়ে তারা নতুন যুগের সূচনা করবে।

২. “প্রলয় বয়েও আসছে হেসে”- উদ্ধৃত অংশের তাৎপর্য লেখ।

উত্তরঃ কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় প্রলয়ের দেবতা রুদ্রদেবকে আহ্বান জানানো হয়েছে। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ধ্বংসের দেবতা রুদ্রদেব পুরাতন যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করেন। শুধু পুরাণে নয়, ইতিহাসেও দেখা গেছে যে, পুরাতন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে নতুন সভ্যতার জন্ম হয়। কালের নিয়ম এটাই যে, পুরাতনকে বিদায় নিতে হয় এবং নতুনের আবির্ভাব ঘটে। অর্থাৎ, ধ্বংসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। এজন্য প্রলয়ঙ্কর প্রলয় বয়ে আনলেও মুখে তার হাসি।

৩. “ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চিরসুন্দর।” – সে কে ? ভেঙে আবার গড়ার বিষয়টি বুঝিয়ে দাও।

উত্তরঃ ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার উল্লিখিত অংশে ‘সে’ বলতে দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতীকে দেশের তরুণ বিপ্লবীদের কথা বলা হয়েছে।

মহাদেব তার রুদ্রমূর্তিতে অসুন্দরের বিনাশ ঘটিয়ে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করেন। একইভাবে দেশের তরুণ বিপ্লবীরাও ধ্বংসের প্রচণ্ডতা নিয়ে আবির্ভূত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারকে আঘাত করাই তাদের লক্ষ্য। তবে অনেকেই সমাজ পরিবর্তনের জন্য যে ‘বিপ্লব’ তাকে ধ্বংসাত্মক বলে মনে করেন। কিন্তু কবির মতে অসুন্দরকে ধ্বংস করেই নবরূপে সমাজ গড়ার মধ্য দিয়ে সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা হয়।

৪. “ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়।” ‘নূতনের কেতন’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ?

উত্তরঃ প্রলয়োল্লাস কবিতার উক্ত অংশে ‘কেতন’ শব্দের অর্থ হলো পতাকা। কবিতায় ‘নূতনের কেতন’ নতুন দিকের সূচনা করার ইঙ্গিত বহন করেছে। ভারতে ইংরেজদের শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য কবি নতুনের জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠেছেন। তারা কালবৈশাখী ঝড়ের মতো, প্রলয়রূপী শিবের মতো সর্বধ্বংসী প্রলয়ের আগমন বার্তা নিয়ে উপস্থিত।

আরও পড়ো

৫. “এবার মহানিশার শেষে / আসবে ঊষা অরুণ হেসে” — ‘মহানিশা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উত্তরঃ ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় ‘মহানিশা’ বলতে কবি রাজনৈতিক, সামাজিক শোষণ ও পরাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী যে অন্ধকারময় অবস্থা তাকে বুঝিয়েছেন। আশাবাদী কবি মনে করেন পরাধীনতা এবং সামাজিক শোষণ, বঞ্চনার মধ্য দিয়ে যে অন্ধকার নেমে এসেছে তার অবসান ঘটে নতুন সূর্যোদয় হবে। মহাদেব ধ্বংসের দেবতা হলেও তার মাথায় থাকে শিশু চাঁদে। তাই ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যে সৃষ্টি সূচিত হবে তাতে সেই চাঁদের আলোয় ঘর ভরে যাবে।

৬. ‘বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর’ – ভয়ংকরের আসার তাৎপর্য কী ?

উত্তরঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভয়ংকরের বেশে নতুনের আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি দেখেছেন, প্রলয়-নেশায় মত্ত হয়ে নৃত্যরত পাগলের ন্যায় বিদ্রোহী শুভশক্তির আগমন ঘটছে। মহাকালের সেই ভয়ংকর মূর্তিতে বিপ্লবী শক্তির আগমন হচ্ছে। সেই শুভ শক্তিকে পরাস্ত করার কিংবা তার সামনে দাঁড়াবার মতো অন্য কোনো শক্তি নেই। ধ্বংসের মধ্য দিয়েই নতুন সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি নিয়েছে সেই ভয়ংকর। এভাবেই দেশ ও জাতির মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন কবি।

৭. ‘অট্টরোলের হট্টগোলে স্তব্ধ চরাচর’ – প্রসঙ্গসহ ব্যাখ্যা দাও।

উত্তরঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় মহাকালের আগমনে প্রলয়-বিক্ষুব্ধ জগতের কথা বলতে গিয়ে উক্ত কথাগুলি বলেছেন।

মহাকাল-স্বরূপ শিব মেতে উঠেছেন তাঁর ধ্বংসলীলায়। বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর তাণ্ডবে কেঁপে উঠছে সমগ্র বিশ্ব। কালবৈশাখীর রূপ ধারণ করে তিনি নতুন সৃষ্টির বার্তা নিয়ে ধেয়ে আসছেন। তাঁর সেই ভয়ংকর আগমনে মুখরিত আকাশ-বাতাস। জগতের জীবকূল সন্ত্রস্ত। আর সেই কারণেই বিশ্ব-চরাচর স্তব্ধ।

৮. ‘বধূরা প্রদীপ তুলে ধর’ – কবি এই আহ্বান করেছেন কেন ?

উত্তরঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সত্য ও সুন্দরের উপাসক। তিনি বাংলার সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভয়ংকরের বেশে নতুনের আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন। কবি দেখেছেন, প্রলয়-নেশায় মত্ত হয়ে নৃত্যরত পাগলের ন্যায় বিদ্রোহী শুভশক্তির আগমন ঘটছে। সেই শক্তি প্রতিষ্ঠা করবে সত্য ও সুন্দরের। সেই প্রলয়ংকর শক্তিকে স্বাগত জানাতেই কবি বধূদের প্রদীপ তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।

রচনাধর্মী প্রশ্ন

১. “তোরা সব জয়ধ্বনি কর।” – কবির এই কথা বলার কারণ সংক্ষেপে লেখো।
অথবা – “তোরা সব জয়ধ্বনি কর” – কাদের উদ্দেশ্য কবির এই আহ্বান? কবিতার ভাববস্তু বিশ্লেষণ করে এই জয়ধ্বনির যৌক্তিকতা বিচার কর।
অথবা – তোরা সব জয়ধ্বনি কর” –কাদের উদ্দেশে, কেন কবি জয়ধ্বনি করতে বলেছেন ?

উত্তরঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভারতবাসীর উদ্দেশ্য এই আহ্বান করেছেন।

আলোচ্য কবিতায় কবি ব্রিটিশদের অত্যাচারে জর্জরিত ভারতবাসীর দুর্দশা মোচনের জন্য এমন একজনকে আহ্বান জানিয়েছেন, যিনি আগে কখনো আসেননি। সেই ‘অনাগত’ হলেন ‘প্রলয়-নেশার নৃত্যপাগল’। প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তিনিও তাণ্ডব করবেন। তার তাণ্ডবের মধ্যেই কবি নতুন যুগের নিশান দেখতে পেয়েছেন। কালবৈশাখী ঝড় যেমন ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির বীজ বপন করে, প্রলয়ঙ্কর তেমনি নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করবে। এই জন্য কবি সকলকে জয়ধ্বনি করতে বলেছেন।

যিনি আসছেন তিনি ভয়ঙ্কর, তিনি প্রলয়ঙ্কর। জগৎ জুড়ে তিনি ধ্বংসলীলা চালাবেন। কিন্তু ওই ধ্বংসের মধ্যেই ‘জরায়-মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ’ লুকিয়ে আছে। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার ধ্বংস করে নতুন যুগের সূচনা করবেন, তিনি ভারতবাসীকে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করবেন এবং নতুন আলোর সন্ধান দেবেন। তাই কবি সকল দেশবাসীকে তার উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনি করতে বলেছেন।

কবির কথায় তারা হলো— “অনাগত প্রলয় নেশার নৃত্যপাগল”, শক্তির প্রচণ্ডতা আর অদম্য স্পৃহায় তারা সমাজের যাবতীয় অসুন্দরকে দূর করতে নিজেরা ভয়ংকরের বেশ ধরে। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নবপ্রাণের প্রতিষ্ঠা ঘটে, প্রাণহীনতার বিনাশ ঘটে— ‘… জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে / জরায় মরা মুমুর্যুদের প্রাণ লুকানো ওই বিনাশ !” তাই সমাজকে সুন্দর করে তুলতে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে। এই কারণেই কবি “তোরা সব জয়ধ্বনি কর” পঙক্তিটি বারবার ব্যবহার করেছেন।

ব্রিটিশ রাজশক্তি স্বাধীনতাকামী তরুণ বিপ্লবীদের অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। কবি আক্ষেপ করে বলেছেন, “অন্ধকারার বন্ধকূপে / দেবতা বাধা যজ্ঞ-যুপে”। এইসব দেবতা-সম বিপ্লবীদের উদ্ধার করবেন তিনি। এইজন্য কবি তাকে স্বাগত জানিয়ে সকল দেশবাসীকে তার উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনি করতে বলেছেন।

ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখ

২. “ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন”- কোন ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে? প্রলয়কে কেন ‘নূতন সৃজন-বেদন’ বলা হয়েছে?

উত্তরঃ কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় কবি পুরাতন, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থা তথা পুরাতন মানসিকতার ধ্বংসের কথা বলেছেন।

আলোচ্য কবিতায় কবি এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে, ধ্বংসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সৃষ্টির বীজ। যেমন, ধ্বংসাত্মক কালবৈশাখী ঝড়ে অনেক গাছপালা ভেঙে পড়ে, বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু ঝড়ের ফলে একদিকে যেমন গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তেমনি বায়ুবাহিত বীজের মাধ্যমে অনেক নতুন চারাগাছের জন্ম হয়।

কবি পরাধীন ভারতবাসীকে ব্রিটিশদের অপশাসনের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য ধ্বংসের দেবতাকেই আহ্বান করেছেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ধ্বংসের দেবতা হলেন রুদ্রদেব। তবে, বাস্তবে কবি দেশের তরুণ বিপ্লবীদের আহ্বান জানিয়েছেন। এই তরুণ বিপ্লবীরা দেশকে পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত করবে বলে কবি আশা পোষণ করেছেন। তবে, স্বাধীনতা লাভের পথ এতটা মসৃণ নয়। বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত দেশের নবীন প্রজন্মকে প্রথমেই হীনবল ভারতবাসীর দীনহীন মানসিকতাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে, তারপরেই তারা ব্রিটিশ রাজশক্তিকে ভারত থেকে উৎখাত করতে পারবে।

কবির মতে, তরুণ বিপ্লবীদের ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে ধ্বংসাত্মক মনে হতে পারে। তাদের কর্মকান্ডে সমাজের স্থিতাবস্থা সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হলেও সেটা নতুন সৃষ্টির প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় জননী যেমন প্রসব-বেদনা অনুভব করে, তেমনি বিপ্লবীদের ক্রিয়াকলাপের মধ্যেও থাকবে নতুনের ‘সৃজন-বেদনা’।

আরও দেখো

৩. ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় একদিকে ধ্বংসের চিত্র, আর এক দিকে নতুন আশার বাণী কীভাবে ফুটে উঠেছে, তা কবিতা অবলম্বনে লেখ।

উত্তরঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় একদিকে রয়েছে ধ্বংসের চিত্র, আর এক দিকে রয়েছে নতুন আশার বাণী। ধ্বংস সব অর্থেই নেতিবাচক, কিন্তু আলোচ্য কবিতায় কবি ধ্বংসের ভয়াবহতার মধ্যে আশার আলোর সন্ধান পেয়েছেন।

কবিতার শুরুতেই ধ্বংসাত্মক কালবৈশাখী ঝড়ের উল্লেখ রয়েছে। তবে, সেই কালবৈশাখী কবির কাছে শুধু ধ্বংসের প্রতীক নয়, ঝড়ের তান্ডবের মধ্যেই কবি নবযুগের কেতন উড়তে দেখেছেন।

ভারতকে পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য কবি যাকে আহ্বান করেছেন, তিনিও ধ্বংসের প্রতীক। তার পরিচয় দিতে গিয়ে কবি বলেছেন, “প্রলয়-নেশার নৃত্যপাগল”। ‘সর্বনাশী জ্বালামুখী ধুমকেতু’ আজ্ঞাবাহী দাসের মতো তার সেবা করে। তার রক্তমাখা তরবারি এবং বজ্রশিখার মশাল দেখে সমস্ত চরাচর যেন স্তব্ধ। জগৎ জুড়ে প্রলয় ঘনিয়ে আসছে দেখেও কবি আশা প্রকাশ করেছেন, “জরায়-মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ-লুকানো ওই বিনাশে!” ওই প্রলয়ের পরেই যেন দীর্ঘ অমাবস্যার সমাপ্তি ঘটবে এবং নতুন দিনের সূচনা হবে।

আবার, মহাকালের সারথি হিসেবে প্রলয়ঙ্করের আগমনের মধ্যেও ধ্বংসের ছায়া চোখে পড়ে। কিন্তু প্রলয়ঙ্করের আগমনের কারণটা ইতিবাচক। এতদিন ধরে যেসব দেবতাদের ‘অন্ধকারার বন্ধ কূপে’ বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তাদের উদ্ধার করার জন্যই মহাকালের সারথি প্রলয়ঙ্কর এগিয়ে আসছেন। অন্যভাবে বললে, কারারুদ্ধ স্বাধীনতাকামী তরুণ বিপ্লবীদের মুক্ত করার জন্যই ধ্বংসের দেবতা রুদ্রদেব আসছেন।

এভাবেই সমগ্র কবিতা জুড়ে কবি এক দিকে ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরেছেন, আর এক দিকে নতুন আশার বাণী শুনিয়েছেন।

পিডিএফ ডাউনলোড কর

৪. ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় কবি প্রলয়ের মধ্যে দিয়ে যে উল্লাস অনুভব করেছেন তা উল্লেখ করো।

অথবা, ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় প্রলয় ও আশাবাদের সুর কীভাবে ব্যক্ত হয়েছে তা বুঝিয়ে লেখো।

অথবা, ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তরঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটি আসলে কবির জীবন উল্লাসের কবিতা। কবিতায় মোট উনিশ বার ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ এই আহ্বানসূচক পঙ্ক্তিটি উচ্চারিত হয়েছে, যা বুঝিয়ে দেয় এই পংক্তিটিকেই কবি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।

শোষণ–বঞ্চনা, পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে জীবনের যে জাগরণ ঘটে, স্বাধীনতা ও সাম্যের দ্বারা যার প্রতিষ্ঠা হয়, তাকেই কবি স্বাগত জানিয়েছেন। যে বছর প্রলয়োল্লাস কবিতাটি প্রকাশ পায় ওই একই বছরে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় নজরুল লেখেন, “পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। সকল কিছু নিয়ম–কানুন, বাঁধন–শৃঙ্খল ও মানা–নিষেধের বিরুদ্ধে।”

প্রলয়োল্লাস কবিতায় দেখা যায় – “সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।” অর্থাৎ এই পঙ্ক্তিটি থেকে বোঝা যায় কবি স্পষ্টই বিদ্রোহের কথা বলেছেন। প্রবল তেজ, বিপর্যয় নিয়ে যে বিপ্লবী শক্তির আগমন ঘটে তা প্রাথমিক ভাবে শঙ্কিত করতে পারে, কিন্তু বিশ্বমায়ের আসন সে–ই পাতে। কবি দেখেছেন—

“অন্ধকারার বন্ধ কূপে
দেবতা বাধা যজ্ঞ–যূপে”

এই দেবতা এখানে স্বাধীনতার প্রতীক। এখান থেকে মুক্ত হয়ে তার আগমনের সময় হয়ে গিয়েছে। তাই ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় কবি বলেছেন, ধ্বংস দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসলে প্রাণহীন অসুন্দরকে বিনাশ করতেই এই ধ্বংস। এরপরেই চিরসুন্দরের প্রতিষ্ঠা ঘটবে। তাকেই স্বাগত জানানোর জন্য সকলকে আহ্বান করেছেন কবি।

আরও দেখো

৫. “কাল ভয়ংকরের বেশে এবার ওই আসে সুন্দর” – কবি কাল ভয়ংকর কাকে বলেছেন ? উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উত্তরঃ প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত প্রলয়োল্লাস শীর্ষক কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।

কবিতায় ‘কাল ভয়ংকর’ বলতে কবি রুদ্ররূপী মহাকাল দেবাদিদেব শিবকে বুঝিয়েছেন। কবির আরও ইঙ্গিত এখানে রয়েছে যাতে বোঝা যায় কবি এক্ষেত্রে জন্মভূমির মৃত্যুভয়হীন নির্ভীক ও মুক্তিকামী তরুণ বিপ্লবীদেরও বুঝিয়েছেন।

তাৎপর্য: সমাজ সচেতন কবি সদাজাগ্রত দৃষ্টিতে সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন – বিদেশি শাসক ইংরেজদের হাতে দেশের মানুষ অত্যাচারিত, কত স্বদেশি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠার জন্য অন্ধকূপ কারাগারে বন্দি। এসব দেখে কবির বিদ্রোহী মন প্রতিবাদী হয়ে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছে। তাই কবি আহ্বান জানালেন প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল মহাকালকে। তার ভয়ংকর রূপে, মলিন কেশের দোলায়, রক্তমাখা কৃপাণের দোলে, অট্টরোলের হট্টগোলে যে মহাপ্রলয় ঘটবে তা মহাকালের জন্যই সংঘটিত হবে। তবে কবি এই প্রলয় আহ্বান করে বিস্মিত না হয়ে বলেছেন— “মাভৈঃ মাভৈঃ! জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে জরায় মরা মুমুর্ষুদের প্রাণ – লুকানো এই বিনাশে !” আর কবির বিশ্বাস ধ্বংসের পর আসে সৃষ্টির মহালগ্ন। তাই তো কবির কণ্ঠে শোনা যায়—

 “এবার মহানিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে।”

কবির বিশ্বাস, মানুষের আশা দীর্ঘ বৎসর পর পুরণ হবে। তাই ‘কাল – ভয়ংকরকে’ দেখে ভয় পেতে কবি নিষেধ করেছেন। কারণ তিনি জানেন ভয়ংকর ভয়ংকর নয়, বরং এক চিরসুন্দর নবরূপে দেখা দেবে। তাই আলোচ্য প্রলয়োল্লাস কবিতায় তারই জয়ধ্বনি করে কবি সবাইকে নব আনন্দে মেতে উঠতে আহ্বান জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!