সাহিত্য সঞ্চয়ন (X)

সিরাজদ্দৌলা – শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির অন্তর্গত সিরাজদ্দৌলা নাটকটিই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়। নাটকটি শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা। পাঠ্যাংশটি মূল নাটকের নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। আমরা আজকের আলোচনায় এই পাঠ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর দেখে নেব। আমরা এর আগে অভিষেক কবিতাটি নিয়ে আলোচনা করেছি।

সিরাজদ্দৌলা – প্রশ্নোত্তর পর্ব

১. ‘আমার এই অক্ষমতার জন্য তোমরা আমাকে ক্ষমা করো।’ – বক্তা কে ? তিনি কার/কাদের কাছে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন ? বক্তার অক্ষমতা কী ছিল ?

উত্তরঃ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাট্যাংশে উদ্ধৃত উক্তিটির বক্তা হলেন নবাব সিরাজদ্দৌলা।

তিনি ফরাসি প্রতিনিধি মঁসিয়ে লা সহ সমস্ত ফরাসিদের কাছে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন।

ফরাসিরা বাংলা তথা এদেশে এসেছিল বাণিজ্য করতে যেমন ইংরেজরা এসেছিল। বাংলায় ফরাসিদের মূল ঘাঁটি ছিল চন্দননগর। এদেশে ফরাসিদের সঙ্গে নবাবের সুসম্পর্ক ছিল। তারা নবাবকে মান্যতাও দিতেন। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অন্যান্য বিষয়ে ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এদেশেও ইংরেজরা নানা ছলে ফরাসিদের বিরোধিতা করত। তারা নবাবকে অমান্য করেই ফরাসিদের ঘাঁটি চন্দননগর আক্রমণ করে এবং ফরাসি কুঠিরে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা করে। এর ফলে ফরাসিরা নবাবের দ্বারস্থ হয় এবং তার প্রতিকার চায়। কিন্তু এ বিষয়ে পর্যাপ্ত অর্থ ও লোকবলের ঘাটতি তথা নবাবের মন্ত্রীসভার অসম্মতির কথা তুলে ধরে নবাব তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেন।

২. ‘আমার সহিষ্ণুতাই আপনাদের স্পর্ধা বাড়িয়ে দিয়েছে।’ – কে কাকে এই কথা বলেছে ? বক্তার সহিষ্ণুতার কোন পরিচয় পাঠ্যাংশে পাওয়া যায় ?

উত্তরঃ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাট্যাংশে উদ্ধৃত কথাগুলি সিরাজদ্দৌলা তাঁর দরবারে উপস্থিত জগৎশেঠকে বলেছেন।

আলোচ্য নাট্যাংশে আমরা সিরাজ চরিত্রের সহিষ্ণুতার পরিচয় পাই। নাট্যাংশের শুরুতেই ওয়াটসের চক্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার পরেও নবাবকে সহনশীল দেখানো হয়েছে। তিনি ওয়াটসকে কোনো কঠোর দণ্ড না দিয়ে কেবল দরবার থেকে বিতাড়িত করেছেন।

মীরজাফর, রাজবল্লভ কিংবা জগৎশেঠ –এরা সকলেই নবাবের সভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। কিন্তু তাঁরা নবাবের প্রতি কোনোভাবেই আস্থাশীল বা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তাঁরা নানাভাবে নবাবের অক্ষমতা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। নবাবের কটূক্তি বা দুর্নাম করতেও পিছপা ছিলেন না তাঁরা। নবাব সিরাজদ্দৌলা এদের প্রতি কঠোর হননি, এক্ষেত্রেও তার সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়।

নবাবের প্রতি অন্যান্য কিছু কর্মচারী এমনকি আত্মীয়-স্বজনও বিতৃষ্ণ ছিলেন। নবাবের বিরুদ্ধে তারা নানা ষড়যন্ত্র করতেন। কেউ কেউ নবাবের মুখের উপরে কটু কথা শোনাতেন। কিন্তু এত সবের পরেও নবাব তাঁর কাঠিন্য দেখান নি। ফলে নাট্যাংশের সর্বত্র আমরা নবাব সিরাজদ্দৌলার প্রচন্ড সহিষ্ণুতার পরিচয় পাই।

৩. ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটক অবলম্বনে নবাব সিরাজের চরিত্র আলোচনা কর।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে বাংলার জনমানসে স্বদেশপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বোধ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ‘সিরাজদ্দৌলা’ (১৯৩৮) নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকে সিরাজ চরিত্রের ঐতিহাসিক বিতর্ক সরিয়ে রেখে কোমলচিত্ত, হতাশাগ্রস্ত স্বদেশপ্রেমিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের পাঠ্যাংশে সিরাজদ্দৌলা চরিত্রের নানা দিক প্রকাশ পেয়েছে যা থেকে চরিত্রটির সার্বিক মূল্যায়ন করা যায়।

নাট্যাংশের শুরুতে ফরাসি প্রতিনিধি মঁসিয়ে লা ইংরেজদের কপটতা ও অত্যাচারের প্রতিকারের আশায় নবাবের কাছে যান। নবাব এক্ষেত্রে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। নবাবের এই আচরণে তাঁর বিনয়ী মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে।

শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত অঙ্কিত সিরাজদ্দৌলা চরিত্রে আছে আবেগপ্রবণতা। বাংলার জাতীয় জীবনে যে বিপদের ঘনঘটা তার জন্য নবাবের সভাসদেরা নবাবকেই দায়ী করেন। এক্ষেত্রে নবাব আবেগতাড়িত হয়ে তাঁদের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করে তাদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কখনও তাদের কাছে আবেদন জানান তার সঙ্গ ত্যাগ না করার। আবার ঘসেটি বেগমের তীব্র সমালোচনায় তিনি আহত হলেও যেভাবে নিজের দুঃখের প্রকাশ ঘটান তাতেও তাঁর আবেগী মনের পরিচয় প্রকাশ পায়।

আলোচ্য নাট্যাংশে আমরা নবাব সিরাজদ্দৌলাকে দুর্বল শাসক হিসেবেই দেখি। ঘরে-বাইরে তাঁর শত্রু। নবাব তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত হলেও তাদের কোনো শাস্তির বিধান করতে পারেন না। উলটে তিনি তাঁর শত্রুদের নিষ্কৃতি দিয়েছেন। ফলে শাসক হিসেবে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রকাশ পায়নি।

আরও পড়ো

সিরাজ চরিত্রে আছে হতাশা। তিনি সিংহাসনে বসেছেন মাত্র পনেরো মাস। কিন্তু এর মধ্যে অধিকাংশ সময় তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র ভেদ ও গুপ্তচর পরিচালনায়। অনেক প্রচেষ্টা স্বত্ত্বেও তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই এড়াতে পারেননি। বাংলা ও নিজের উপর নেমে আসা আসন্ন বিপদে তিনি তাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত অঙ্কিত সিরাজদ্দৌলা অবশ্যই দেশপ্রেমিক। নিজের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র কিংবা তাঁর প্রতি ইংরেজদের ঔদ্ধত্য তিনি কখনও ব্যক্তিগত হিসেবে বিচার করেননি, তা বাংলার বিপদ হিসেবেই দেখেছেন তিনি। তাইতো তাকে বলতে শোনা যায় – ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।’ বাংলাকে আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচাতে তাই তিনি তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করেছেন। অতএব পাঠ্যাংশের সিরাজ চরিত্রটি নানা দুর্বলতা স্বত্ত্বেও দেশপ্রেমী সত্তায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

৪. ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটক অবলম্বনে ঘসেটি বেগমের চরিত্র আলোচনা কর।

আমাদের পাঠ্য ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাট্যাংশে দুটি নারী চরিত্র পাওয়া যায় –ঘসেটি বেগম ও লুৎফা। দুটি চরিত্রের মধ্যে দয়ামায়াহীন ষড়যন্ত্রকারী চরিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য হল ঘসেটি বেগম।

ঘসেটি বেগম হলেন নবাব আলিবর্দির কন্যা এবং সম্পর্কে সিরাজের মাসি। নিঃসন্তানা এই মহিলা ছিলেন ক্ষমতা পিপাসু। নবাব আলিবর্দির মৃত্যুর পর মসনদের দাবিদার হিসেবে শওকতজঙ্গের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। তিনি কোনোভাবেই চাননি সিরাজ নবাবের সিংহাসনে বসুক। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিহিংসাপরায়ণ। মনে-প্রাণে সিরাজের পতন চাওয়া ঘসেটি নবাবের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে শুরু করেন। এমনকি ইংরেজদের পক্ষে থেকে তিনি সিরাজের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে চলেন। তার হিংসা সিরাজের সামনে প্রকাশ করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। তিনি সিরাজের ভবিষ্যৎ করুণ পরিণতি চেয়ে অভিসম্পাত দেন। জীবনযুদ্ধে বারংবার তিনি পরাজিত হয়ে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রকটিত হয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!