নদীর বিদ্রোহ
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত নদীর বিদ্রোহ গল্প। আমরা এর আগে সাহিত্য সঞ্চয়ন বই থেকে অন্যান্য নানা পাঠ্যের আলোচনা করেছি। আজকের আলোচনায় আমরা এই গল্প থেকে প্রাসঙ্গিক তথ্য ও নানা প্রশ্নোত্তর দেখে নেব।
নদীর বিদ্রোহ – প্রাসঙ্গিক তথ্য
১. উৎস – ‘সরীসৃপ’ গল্পগ্রন্থ
২. গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হল নদেরচাঁদ।
৩. নদেরচাঁদের বয়স ত্রিশ বছর। নদেরচাঁদ পেশায় ছিল স্টেশন মাস্টার।
৪. নদেরচাঁদ রওনা করিয়ে দিয়েছিল চারটে পঁয়তাল্লিশের প্যাসেঞ্জার ট্রেনটিকে।
৫. রচনা অনুসারে বৃষ্টি হয়েছিল টানা পাঁচদিন। এই পাঁচদিন নদেরচাঁদ নদীকে দেখেনি।
৬. নদেরচাঁদ এই স্টেশনে আছে চার বছর ধরে।
৭. নদীর স্রোতে পুরনো একটা চিঠি ছুড়েছিল নদেরচাঁদ। চিঠিটি ছিল তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে লেখা। চিঠিটি ছিল পাঁচ পৃষ্ঠার।
৮. মুষলধারায় বৃষ্টি চলেছিল ঘন্টা তিনেক।
৯. ‘তাহাকে বিশ্বাস নেই’ – নদীর সম্পর্কে বলা হয়েছে।
১০. নদেরচাঁদকে পিষে দিয়েছিল ৭নং ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেন।
প্রশ্নোত্তর পর্ব
১. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।”- কে বুঝতে পেরেছে? ‘নদীর বিদ্রোহ’ বলতে সে কী বোঝাতে চেয়েছে?
উত্তরঃ ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে আমরা দেখি ছোটোবেলা থেকেই নদেরচাঁদের সমস্ত কিছু নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। নদীর ভাষা সে বুঝবে এটাই স্বাভাবিক। বর্ষণ-পুষ্ট উত্তাল নদীকে সে ক্ষিপ্ত ও বিক্ষুব্ধ বলে চিনতে পেরেছিল। মানুষের তৈরি বাঁধ এবং ব্রিজ নদীকে শীর্ণকায় করে তোলায় নদী যে তাতে ক্ষুব্ধ, নদীর বিদ্রোহের, কারণ নদেরচাঁদ তার সংবেদনশীল মন দিয়ে তা উপলব্ধি করেছিল। মানুষের প্রযুক্তির কাছে অবদমিত প্রকৃতি যেন নদীর মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চাইছে। নদেরচাঁদ বুঝেছিল, প্রকৃতির প্রতি মানুষের অবিচারই মানব সভ্যতাকে একদিন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।
নদেরচাঁদ সংবেদনশীল মানুষ। নদীকে নিয়ে তার কৌতূহল পাগলামির পর্যায়ের হলেও নদীকে নিয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি তাকে অনন্য পূর্ব সিদ্ধান্তে উপনীত করে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান দাম্ভিক মানুষ যেভাবে প্রকৃতিকে বশে আনতে নদীর বুকে ব্রিজ বানিয়েছে, বাঁধ বেঁধেছে – এই অন্যায়ের প্রতিবাদ যেন ধ্বনিত হয় নদীর গর্জনে, সবকিছুকে ভেঙে ফেলার চেষ্টায়। নদীর এই কাজকে যেন সমর্থন করে চলে প্রকৃতির বৃষ্টি, মেঘ ও অন্ধকার। প্রকৃতির এইসব আয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে নদীর বিদ্রোহকে নদেরচাঁদ অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করেছে।
২. “নিজের এই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে।”- কার কথা বলা হয়েছে ? তার ‘পাগলামিটি’ কী ? তার আনন্দ উপভোগের কারণ কী ?
উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘সরীসৃপ’ গ্রন্থের নয় সংখ্যক গল্প “নদীর বিদ্রোহ” থেকে প্রশ্নোক্ত তাৎপর্যপূর্ণ অংশটি চয়ন করা হয়েছে। প্রশ্নোক্ত অংশে নদী প্রেমিক স্টেশনমাস্টার নদেরচাঁদের পাগলামির কথা বলা হয়েছে।
নদী-অন্তপ্রাণ নদেরচাঁদ নদীর সাথে এক অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। স্টেশনমাস্টারের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও একদিনও নদীকে না দেখে থাকা নদেরচাঁদের পক্ষে সম্ভবপর ছিলনা। পাঁচদিন অবিরাম বর্ষণের পরবর্তিতে নদীর উত্তাল রূপ কল্পনাকারী নদেরচাঁদের নদীর কাছে ছুটে যাওয়ার ঘটনাকেই প্রশ্নোক্ত অংশে ‘পাগলামি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
আমাদের ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখো
বর্ষণ মুখর উন্মত্ত নদীস্রোত দেখে নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হয়ে যায়- “জলপ্রবাহকে আজ তাহার জীবন্ত মনে হইতেছিল।” নদীর ভয়াল রূপে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখে – “নদেরচাঁদের ভারী আমোদ বোধ হইতে লাগিল।” আর তখনই সে শিশুসুলভ ঔৎসুক্য দেখিয়ে তার পকেট থেকে দুই দিনের প্রচেষ্টায় তার স্ত্রীকে লেখা পাঁচ পৃষ্ঠা ব্যাপী পত্রটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে চঞ্চল নদীস্রোতে ভাসিয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে তার সমগ্র সত্তা দিয়ে নদীকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এই ভাবেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নদেরচাঁদ তার আত্মার আত্মীয় নদীর খরস্রোতা রূপ দেখে আনন্দ উপভোগ করে।
আরও দেখো
৩. ‘এই নদীর মতো এত বড়ো ছিল না’ – কোন্ নদীর কথা বলা হয়েছে ? সেই নদী কেমন ছিল ?
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে গল্পের প্রধান চরিত্র নদেরচাঁদ যে গ্রামে বড় হয়ে উঠেছিল, সেই গ্রামের ছোটো নদীর কথা বলা হয়েছে।
নদেরচাঁদের গ্রামের নদীটি ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট। কিন্তু কিশোর অবস্থায় নদেরচাঁদের ঐ নদীকে ছোটো বলে মনে হত না, তার দেশের সেই ক্ষীণস্রোতা নির্জীব নদীটি, অসুস্থ দুর্বল আত্মীয়ার মতোই নদেরচাঁদের ভালোবাসা, মমতা পেয়েছিল। পরে বড় হয়ে একবার যখন নদেরচাঁদ নদীটিকে ক্ষীণস্রোত অবস্থায় দেখেছিল, তখন পরমাত্মীয় মারা গেলে যে রকম দুঃখ হয়, সে প্রকার দুঃখ পেয়েছিল। বলা যায়, দেশের নদীর সাথে নদেরচাঁদের একপ্রকার আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
৪. “নদেরচাঁদের ভারী আমোদ বোধ হইতে লাগিল।” – উদ্ধৃতাংশটিতে কার কথা বলা হয়েছে? তার আমোদ হওয়ার কারণ কী?
উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশটিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নদীর বিদ্রোহ’ ছোটোগল্পের প্রধান চরিত্র নদেরচাঁদের কথা বলা হয়েছে।
স্টেশনমাস্টার নদেরচাঁদ নদী ভালোবাসে, সে প্রতিদিন বিকালে তার ষ্টেশনের পাশের নদীটিকে দেখতে যায়। পাঁচ দিন টানা বৃষ্টির ফলে সঙ্কীর্ণ, ক্ষীণস্রোতা নদীর চেহারা হয়েছে ভয়ংকর। ব্রিজের মাঝে বসা নদেরচাঁদের মনে হয় ‘ক্ষিপ্র নদী যেন ব্রিজের ধারক স্তম্ভগুলোতে বাধা পেয়ে ফেনিল আবর্ত’ সৃষ্টি করছে। নদীর জল এতটা উঁচুতে উঠে এসেছে যে যেন মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। নদীর এইরূপ অবস্থা দেখে নদেরচাঁদের ভারি আমোদ হয়।
৫. “বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদেরচাঁদের।” – নদেরচাঁদের ভয়ের কারণ কী ?
উত্তরঃ ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের প্রধান চরিত্র নদীপ্রেমী নদেরচাঁদ প্রতিদিন বিকালে নদীর সাথে দেখা করে। পাঁচ দিন টানা বৃষ্টির ফলে তাঁর পরিচিত সঙ্কীর্ণ, দুর্বল নদী পরিবর্তিত হয়েছে স্রোতস্বিনী তেজী নদীতে। নদীর এই ভয়ংকর রূপে মোহিত হয়ে রেলব্রিজের মাঝে বসে থাকে। মাঝে বৃষ্টি আসে, কিন্তু প্রকৃতিপ্রেমে আচ্ছন্ন নদেরচাঁদ বসে থাকে। এমনকি, সে এও ভুলে যায় যে তার থেকে মাত্র একটু নীচ দিয়েই ভয়াল বেগে বয়ে চলেছে নদী। ক্রমে দিনের আলো নিভে যায়, বৃষ্টির বেগ বৃদ্ধি পায়, আচমকা রেলের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় সে। প্রকৃতির রুদ্ররূপ দেখে বিপদের আশঙ্কায় নদেরচাঁদের ভয় হয়।
৬. “নদীর ধারে তার জন্ম হইয়াছে”— কার কথা বলা হয়েছে ? এ কথা বলার কারণ কী ?
উত্তরঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদের কথা বলা হয়েছে।
এ কথা বলার কারণ: নদীকেন্দ্রিক জীবনে যারা অভ্যস্ত তাদের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক বারোমাস। নদেরচাঁদ নদীকে না দেখে থাকতে পারেনা। সে নিজেও তা বোঝে, তবু নিজেকে সংযত করতে পারেনা। নদীর প্রতি তার ভালবাসার কারণ আছে। নদীর ধারে তার জন্ম হয়েছে। নদীর ধারেই সে শৈশব, বাল্য, কৈশোর কাটিয়েছে। তাই নদীর প্রতি ভালবাসা তার অদম্য।

